পূর্বধলায় জমি নিয়ে সংঘর্ষে আহত ব্যক্তির নাম ‘জুলাই যোদ্ধা’ গেজেটে
জমি নিয়ে বিরোধে আহত হলেও সরকার পতনের আন্দোলনে আহত দাবি করে ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে গেজেটে নাম উঠিয়েছেন নেত্রকোনার পূর্বধলার জসিম উদ্দিনশফিকুল আলম শাহীন : জমি নিয়ে বিরোধে আহত হলেও সরকার পতনের আন্দোলনে আহত দাবি করে ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে গেজেটে নাম উঠিয়েছেন নেত্রকোনার পূর্বধলার জসিম উদ্দিন (৬৫)। শুধু তাই নয়, ইতোমধ্যে তিনি সরকারি ভাতাও উত্তোলন করেছেন। তবে সম্প্রতি বিষয়টি প্রকাশ্যে আসায় এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের পাশাপাশি তীব্র সমালোচনার ঝড় উঠেছে।
ঘটনা শুধু এক ব্যক্তির প্রতারণা নয়, বরং প্রশ্ন তুলছে, কীভাবে যাচাই-বাছাই ছাড়াই নাম ঢুকে যাচ্ছে ‘জুলাই যোদ্ধাদের’ গেজেটে ?খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলার খলিশাউড় ইউনিয়নের পাবই গ্রামের মৃত মফিজ উদ্দিনের ছেলে জসিম উদ্দিন গত ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই দুপুরে তারই ভাতিজা মৃত ফুল মিয়ার ছেলে আব্দুল মান্নান ও হান্নানদের সাথে জমি নিয়ে বিরোধে সংঘর্ষে ডান চোখে আঘাত পেয়ে আহত হন।
স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও পরে ঢাকার আগারগাঁও চক্ষু হাসপাতালে ভর্তি করেন।
কিন্তু ঘটনার চিকিৎসা সংক্রান্ত কাগজপত্র ব্যবহার করে জসিম উদ্দিন দাবি করেন, তিনি নাকি সরকার পতনের আন্দোলনে আহত হয়েছেন। সেই মিথ্যা দাবি সমর্থন করেই তিনি ‘জুলাই যোদ্ধা’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান। তার গেজেট নম্বর ৩৬৩, মেডিকেল কেস আইডি ১২৮৮৭।
প্রতিপক্ষ আব্দুল মান্নান বলেন, দীর্ঘদিন যাবত জসিম চাচার সাথে আমাদের জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ চলে আসছিল। এ নিয়ে অনেক দেন-দরবারও হয়েছে।
গত ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই দুপুরে আমাদের দুই পক্ষের কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে চাচা জসিম উদ্দিন ও তার লোকজন আমাদের ওপর হামলা চালায়। তাদের লাঠিসোটার আঘাতে আমিসহ আমার পরিবারের ৪জন আহত হই। এসময় কিভাবে যেন চাচার চোখে আঘাত লাগে।
এখন দেখি চাচা আন্দোলনে আহত হয়ে ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে নাম লিখিয়েছে, এটা আমাদের কাছে বিস্ময়কর। আব্দুল মfন্নান ক্ষোভের সাথে আরও বলেন, চাচা আমাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে দুই মাস জেল খাটিয়েছে। আমি এর বিচার চাই।
স্থানীয় ইউপি সদস্য কামাল মিয়া জানান, জমি বিরোধের জেরেই জসিম উদ্দিন আহত হয়েছিলেন। এ নিয়ে আমরা সালিশও করেছি। তবে শুনেছি জুলাই যোদ্ধা হিসেবে তিনি তালিকাভূক্ত হয়েছেন। এখন আবার শুনছি জুলাই যোদ্ধার তালিকা থেকে তার নাম বাদ দেওয়ার জন্য আবেদনও করেছেন।
কথা হয় জসিম উদ্দিনের সাথে, নিজের অপরাধ স্বীকার করে জসিম উদ্দিন বলেন, জমি সংক্রান্ত বিরোধে প্রতিপক্ষের হামলায় আমার ডান চোখে আঘাত লাগে। আমি গত বছরের ২১ জুলাই ঢাকায় জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি হই। সেখানে কে বা কারা আমার নাম জুলাই যোদ্ধার তালিকায় উঠিয়েছে আমি জানিনা।
ইতিমধ্যে আমি সরকার থেকে যে টাকা পেয়েছি তা খরচ করে ফেলেছি। আমি গরীব মানুষ সরকারকে টাকা ফিরিয়ে দেওয়ার সামর্থ আমার নেই। আমার চোখটি নষ্ট হয়ে গেছে। আমি অন্ধ হয়ে গেছি।
তবে আমি যে এটা ভুল করেছি তা এখন বুঝতে পারছি, এটা করা আমার ঠিক হয়নি। আমার জুলাই যোদ্ধা সনদ বাতিলের জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর আবেদন করেছি।
জসিম উদ্দিন ‘জুলাই যোদ্ধা’ এ ঘটনার পর থেকেই এলাকায় চলছে আলোচনা-সমালোচনা। স্থানীয়দের মতে, এভাবে জুলাই যোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ায় প্রকৃত আন্দোলনকারীদের সম্মান ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। সাধারণ মানুষও প্রশ্ন তুলছেন, তদন্ত ছাড়া কীভাবে এমন নাম অন্তর্ভুক্ত হলো তালিকায় ?
স্থানীয় সমাজকর্মীরা বলছেন, আন্দোলনের ইতিহাস বিকৃত করা শুধু প্রতারণা নয়, জাতীয় আত্মত্যাগের মর্যাদাকেও হেয় করার সামিল।
পূর্বধলার এই ঘটনা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে ‘জুলাই যোদ্ধা’ তালিকায় ওই ব্যক্তির নাম অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পেছনে রয়েছে প্রমাণপত্র যাচাইয়ের ঘাটতি। এক্ষেত্রে সরকারের কঠোর নজরদারি ও স্বচ্ছ তদন্তই পারে প্রকৃত আন্দোলনকারীদের মর্যাদা রক্ষা করতে।
এ বিষয়ে নেত্রকোনা জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. গোলাম মাওলা নঈম জানান, জসিম উদ্দিন পারিবারিক বিরোধে আহত হওয়ার বিষয়টি আমরা এখনই জানতে পেরেছি। আর তখনতো সেভাবে যাচাই-বাচাই হয়নি।
এখন তিনি তার ভুল বুঝতে পেরে গত ১৮ আগস্ট সনদ বাতিলের জন্য আবেদন করেছেন। গেজেট থেকে তার নাম প্রত্যাহার করার জন্য আমরা ইতোমধ্যেই তার আবেদন জুলাই যোদ্ধা ফাউন্ডেশন মন্ত্রনালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন