কুঁসিকাটায় জীবন পাল্টেছে লিজার..
লিজা শুধু একজন উদ্যোক্তা নন, তিনি অনেক নারীর অনুপ্রেরণার নাম। কুঁসিকাটা আর অদম্য ইচ্ছাশক্তিই পাল্টে দিয়েছে তাঁর জীবন— বদলে দিয়েছে আরও অর্ধশত নারীরম. কিবরিয়া চৌধুরী হেলিম, নেত্রকোণা : “দিনে সংসারের কাজ, রাতে সুঁই-সুতার নকশা— এমন করেই শুরু হয়েছিল আমার নতুন জীবন।” বলছিলেন নেত্রকোণার পঁচাশিপাড়া গ্রামের আফরোজা আক্তার লিজা (৩৮)। আজ তাঁর তৈরি কুশিকাটা ও বাটিকের পোশাক শুধু শহরেই নয়, দেশের গণ্ডি পেরিয়ে পৌঁছে গেছে আমেরিকা, কানাডাসহ বিদেশের বাজারেও।
একসময় সংসারের অবহেলা, লাঞ্ছনা আর সামাজিক রক্ষণশীলতার বেড়াজালে আটকে ছিলেন লিজা। বিয়ের আট বছর পর সংসার টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। এক সন্তানকে নিয়ে ফিরে আসতে হয় বাবার ঘরে। তখন থেকেই শুরু হয় জীবনের অন্য এক যুদ্ধ— অর্থনৈতিক স্বাধীনতার যুদ্ধ।বাবার মালনী রোডের পাটপট্টি এলাকার বাসায় উঠে শৈশবের শেখা সুঁই-সুতার কাজকেই জীবিকার পথ করে নেন। যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ও বিসিক থেকে নেন বাটিক, সেলাই, বিউটিফিকেশনসহ নানা প্রশিক্ষণ। নিবন্ধিত হন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে। হাতে ছিল মাত্র পাঁচ হাজার টাকা— সেই টাকায় শুরু করেন শিশুদের জামা তৈরির ছোট উদ্যোগ। দোকান থেকে দোকানে পণ্য সরবরাহ করে ধীরে ধীরে জমাতে থাকেন পুঁজি ও আত্মবিশ্বাস।
পরে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে ৬০ হাজার টাকার ঋণ পান। ২০২৩ সালে শহরের নাগড়া শিববাড়ি এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেন “লিজা বুটিকস হাউজ”। বর্তমানে তাঁর প্রতিষ্ঠানটিতে পঞ্চাশেরও বেশি নারী কাজ করছেন। তাঁরা বাড়িতে বসে পণ্য তৈরি করে সরবরাহ করেন লিজার কাছে।
বুটিকস হাউজের কর্মী কামরুন্নাহার বাবলী বলেন, “লিজা আপার কল্যাণে আমার সংসারের অভাব মিটেছে। তাঁর কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এখন মাসে ভালো আয় করি, ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ দিতে পারি।”
আরেক নারী মিনা বেগম বলেন, “লিজা আপা আমার জীবন বদলে দিয়েছেন। এখন ঘরে বসেই কাজ করি, আয় হয় নিয়মিত। সংসারে আর আগের মতো কষ্ট নাই।”
এমনই গল্প ছড়িয়ে আছে নেত্রকোণার বিভিন্ন প্রান্তে। চৈতি সরকার, রুণা সরকার, ডলি দেবনাথ, তন্নী সাহা— অর্ধশতাধিক নারী আজ লিজার উদ্যোগে স্বাবলম্বী।
নিজের গল্প প্রসঙ্গে লিজা পূর্বকন্ঠকে বলেন, “স্বামী মাদকাসক্ত ছিলেন, সংসারে শান্তি পাইনি। কিন্তু হাল ছাড়িনি। সুঁই-সুতাকে আঁকড়ে ধরেই নতুন জীবন শুরু করি। এখন স্বপ্ন দেখি বড় শোরুম আর নিজের কারখানা গড়ার। আমার কুশিকাটার পণ্যকে আমি ব্র্যান্ডে রূপ দিতে চাই।”
তিনি আরও বলেন, “সব নারী যেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেন— আমি চাই তারা কেউ যেন পরের বোঝা না হন। তাহলেই সমাজে পরিবর্তন আসবে।”
জেলা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের উপপরিচালক ফারজানা পারভীন বলেন, “লিজা যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আজ সফল উদ্যোক্তা। তাঁর উদ্যোগে বহু নারী অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন। পাশাপাশি তিনি সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজেও যুক্ত রয়েছেন, যা সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে।”
আজ লিজা শুধু একজন উদ্যোক্তা নন, তিনি অনেক নারীর অনুপ্রেরণার নাম। কুঁসিকাটা আর অদম্য ইচ্ছাশক্তিই পাল্টে দিয়েছে তাঁর জীবন— বদলে দিয়েছে আরও অর্ধশত নারীর ভাগ্য।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন